সাকার ২৩ অপরাধ

বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী ২৩টি অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে তিন শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা, পাঁচজনকে ধর্ষণে সহযোগিতা করা, ছয়টির বেশি গণহত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি) এবং ৩(২)(এইচ) ধারায় এ অভিযোগ গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বুধবার (৪ এপ্রিল ২০১২) অভিযোগ গঠন করে ২৯ এপ্রিল থেকে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন এবং সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে প্রসিকিউশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে সাকা চৌধুরীর বিচার হলো। এর আগে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্যিদয়ে বিচার শুরু হয়। সাঈদীর বিরুদ্ধে এখন সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।

সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে ২৩টি অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে, সেগুলো হলো :
১. একাত্তরের ৪ বা ৫ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার রামজয় মহাজন লেনের বাসিন্দা মতিলাল চৌধুরী, শান্তি কুসুম, সুনীলসহ আরো সাতজনকে ধরে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ি গুডহিলে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে মতিলাল চৌধুরীর কর্মচারী সুনীলকে ছেড়ে দেওয়া হয় মারাত্মক আহত অবস্থায়। কিন্তু মতিলাল, শান্তি কুসুমসহ বাকি ছয়জনকে নির্যাতন করে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে।
২. একই বছরের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাউজান থানার মধ্য গহিরার হিন্দুপাড়ার লোকজনকে ধরে নিয়ে ডা. মাখন লাল শর্মার বাড়িত জড়ো করে মাখন লাল শর্মা, পঞ্চবালা শর্মাসহ পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওই হত্যাকাণ্ড চালায়।
৩. একই দিন একই এলাকার কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের নুতন চন্দ্র সিংহকে মন্দিরে প্রার্থনারত অবস্থায় ধরে নিয়ে নির্যাতন করে পাকিস্তান সেনারা। পরে সাকা চৌধুরী গুলি করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
৪. মুক্তিযুদ্ধের সময় ভীত-সন্ত্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন যখন নিজেদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন, ঠিক তখন সাকা চৌধুরীর সহযোগী আবু মাবুদসহ দুই ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের মধ্যগহিরার জগৎমল্ল পাড়ায় কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়িতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের জড়ো করে। শান্তি কমিটির সভা করার নামে সেখানে তাদের জড়ো করা হয়। শান্তি কমিটির সভায় যোগ দিলে যদি জীবন বাঁচেএ আশায় তাঁরা তাতে যোগ দেন। লোক জড়ো হওয়ার পর বিষয়টি জানানো হয় সাকা চৌধুরীকে। কিছুণ পর সাকা চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে হাজির হন। এরপর সেনারা চালায় ব্রাশফায়ার। ঘটনাস্থলেই তেজেন্দ্র লাল নন্দী, সমির কান্তি চৌধুরী, কিরণ বিকাশ চৌধুরীসহ ৩২ জন নিহত হন। কয়েক দিন পর নিহতদের ওই বাড়ির উঠানেই গণকবর দেওয়া হয়। এ ছাড়া আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে।
৫. একই দিন দুপুর ১টার দিকে রাউজানের সুলতানপুরের বণিকপাড়ায় সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে নেপাল চন্দ্র ধরসহ চারজনকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
৬. হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ এলাকায় থাকবে কি থাকবে না, এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে রাউজানের উনসত্তরপাড়ায় িিতশ চন্দ্র মহাজনের বাড়ির পেছনে পুকুরপাড়ে ১৩ এপ্রিল ডাকা হয় শান্তি কমিটির সভা। এলাকার লোকজন সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর সাকা চৌধুরীসহ পাকিস্তান বাহিনী সেখানে হাজির হয়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী ব্রাশফায়ার করে। এতে চরণ পাল, মন্তোষ মালী, বাবুল মালীসহ ৭০ জনের বেশি ব্যক্তি নিহত হয়। এদের মধ্যে ৫০ জনের নাম জানা গেছে। হত্যার পর সেখানেই গণকবর দেওয়া হয় লাশ।
৭. একই বছরের ১৪ এপ্রিল রাউজান পৌরসভা এলাকায় সতিশ চন্দ্র পালিতকে তাঁর বাড়িতে ঘরের মধ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার পর নিহত সতিশ চন্দ্রের পরিবারের সদস্যরা ভয়ে ভারতে চলে যায়।
৮. একাত্তরের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মোজাফফর আহমেদ ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে। সেখানে নির্যাতন চালিয়ে পিতা-পুত্রকে হত্যা করা হয়।
৯. মধ্য এপ্রিলে সাকা চৌধুরীর নির্দেশে রাউজান থানার কদুরখিল হিন্দুপাড়ার শান্তি দেবকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
১০. রাউজানের ডাবুয়া গ্রামের মানিক ধরের বাড়িসহ ওই এলাকার হিন্দুদের বাড়িতে সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে লুটপাট চালানো হয়।
১১. একাত্তরের ২২ এপ্রিল রাউজানের শাকপুরা গ্রামে ফয়েজ আহমেদ, আলাল আহমেদ, আহাম্মদ ছফা, নিকুঞ্জ শীলসহ অসংখ্য ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫২ জনকে শনাক্ত করা গেছে। পাকিস্তান বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে এলাকার লোকজন শাকপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বর্বর সেনাবাহিনী সেখানে ব্রাশফায়ার চালায়। এতে ওইসব ব্যক্তি নিহত হয়। এ গণহত্যার পর অনেকে ভয়ে ভারতে চলে যায়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তাঁর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে ওই হত্যাকাণ্ড চালানো হয় বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
১২. রাউজানের জগতমল্লপাড়ায় বিজয় কৃষ্ণ চৌধুরী, হরেন্দ্র লাল চৌধুরীসহ চারজনকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করে সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে।
১৩. একাত্তরের ১০ মে ঘাসি মাঝিরপাড় এলাকায় সাকা চৌধুরী ও তাঁর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নুরুল আলম, আয়েশা খাতুন, জানে আলম ও আবুল কালামকে হত্যা করে। সেখান থেকে সাকা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর সহযোগীরা পাঁচ নারীকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সেখানে ওই মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়।
১৪. একাত্তরের ২০ এপ্রিল রাউজানের কর্তার দিঘীরপাড় এলাকার মো. হানিফকে অপহরণ করে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।
১৫. সে বছরের ৭ জুন ওমর ফারুক নামের এক ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়।
১৬. একাত্তরের ১৫ জুলাই চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনের জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি থেকে নিজামউদ্দিনসহ সাতজনকে ধরে নিয়ে গুডহিলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরবর্তী সময়ে নিজামউদ্দিনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৭. সে বছরের ১৩ জুলাই শিকারপুর ইউপি চেয়ারম্যান শামসুদ্দিনেক ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
১৮. সে বছরের ২৭ জুলাই বোয়ালখালীর এখলাস মিয়াকে ধরে নিয়ে গুডহিলে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
১৯. ফজলুল হক চৌধুরী নামের এক ইউপি চেয়ারম্যানকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
২০. মধ্য মে-তে চন্দরপুর থেকে শেখ মায়মুন অলী চৌধুরীকে ধরে গুডহিলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
২১. নূর মোহাম্মদ ও তাঁর ভাই নূর আলমকে হাটহাজারীর মিয়া বাড়ি থেকে ২৭ জুলাই গুডহিলে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে এক ভাইকে ছেড়ে দেওয়া হলেও অন্যজনকে হত্যা করা হয়।
২২. একাত্তরের ২ সেপ্টেম্বর সলিমুল্লাহকে গুডহিলে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
২৩. সে বছরের আগস্টে নূর চৌধুরী নামের এক যুবককে ডবলমুরিং থানার সদরঘাট এলাকা থেকে ধরে নিয়ে গুডহিলে নির্যাতন করা হয়।
ফরমাল চার্জে ৪৩৭ ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগ : রাষ্ট্রপ থেকে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে রাউজানসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে কমপে ৪৩৭ ব্যক্তিকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল ফরমাল চার্জে। তাঁর বিরুদ্ধে রাউজানের শাকপুরা, উনসত্তরপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। শুধু রাউজানেই ৯টি গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে ফরমাল চার্জে। সাকা চৌধুরীর উপস্থিতি ও নির্দেশে তাঁর সহযোগীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ওইসব ঘটনা ঘটায় বলে অভিযোগ করে রাষ্ট্রপ। মূলত হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নিশ্চিহ্ন করা এবং হিন্দুদের দেশান্তরে বাধ্য করার জন্যই ওইসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় বলে রাষ্ট্রপরে অভিযোগ। অভিযোগে বলা হয়, সাকা চৌধুরীর চট্টগ্রামের বাসভবন ‘গুডহিল’কে টর্চার সেন্টার করা হয়েছিল। সেখানে ক্রমাগতভাবে শহরের মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু লোকজন, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারীদের ধরে নিয়ে টর্চারের পর হত্যা করা হতো।
তদন্ত সংস্থা তদন্ত শেষে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৩২টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে গত বছর ৪ অক্টোবর ১১৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ট্রাইব্যুনালে। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়। এরপর তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৫টি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১৪ নভেম্বর ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। ১৭ নভেম্বর সাকা চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে ফরমাল চার্জ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের জন্য ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে তদন্ত সংস্থা। গাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে বনানীর একটি বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

 

 

 

1 Comment

Filed under Crimes against huminity, War crimes

One response to “সাকার ২৩ অপরাধ

  1. Joy ahmed

    Ami cai

Leave a comment